Saturday, December 24, 2016

সুস্থতার জন্য ঘুম

সুস্থতার জন্য ঘুম
বড়দের চেয়ে ছোটদের বেশি সময় ঘুম প্রয়োজন।

সুস্থ থাকার জন্য ঘুম খুব জরুরি। তবে এই ঘুম হতে হবে যথাযথ। বিভিন্ন বয়সে ও মানুষভেদে বিভিন্নজনের
প্রয়োজনীয় ঘুমের সময় আলাদা হতে পারে; কিন্তু পুরো শারীরিক প্রক্রিয়াকে সচল ও কর্মক্ষম রাখার জন্য নির্দিষ্ট সময় ঘুমাতে হবে। মানুষকে ঘুমাতে হয়। সাধারণভাবে মনে হয়, ক্লান্তি আর অবসন্নতা দূর করার জন্য ঘুম একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া।
কিন্তু ঘুম শুধু ক্লান্তি আর অবসন্নতা দূরের বিষয় নয়, পুরো শরীরের সুস্থতাই নির্ভর করে এর ওপর। তবে সবার জন্য সমান সময় না ঘুমালেও চলে। প্রাকৃতিকভাবেই কারো ঘুমের চাহিদা বেশি, কারো কম। তাই কেউ একটু বেশি ঘুমায়, কেউ কম। তাই বলে অতিরিক্ত ঘুম কিন্তু ভালো নয়। শিশু ছাড়া অন্যদের ঘুম যেন দশ ঘণ্টা অতিক্রম না করে।
অনেকের অল্প ঘুমালেও শরীর ঠিক থাকে। সাধারণত তাঁরা দৈনিক গড়ে পাঁচ ঘণ্টা ঘুমিয়েই পরিতৃপ্তিবোধ করেন। তাঁদের বলা হয় শর্ট স্লিপার। যদিও গড়ে ছয়-সাত ঘণ্টা ঘুম সুস্থ থাকার জন্য প্রয়োজন বলে মনে করা হয়। কিন্তু শর্ট স্লিপারদের একটু কম হলেও ক্ষতি হয় না। আবার যাঁরা গড়ের চেয়ে একটু বেশি সময় ঘুমান, তাঁদের বলা হয় লং স্লিপার। তাঁরা আট থেকে ১০ ঘণ্টাও ঘুমান।

ঘুম একটি বায়োলজিক্যাল বা শরীরবৃত্তীয় ঘড়ি। আমাদের দেহের বৃদ্ধি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, মস্তিষ্কের স্মৃতি সংরক্ষণ, মস্তিষ্কের কোষের কার্যকারিতা ঠিক রাখার জন্য ঘুম অপরিহার্য। প্রতিদিন জেগে থাকা এবং ঘুমানোর এই চক্র সারা জীবন চলতে থাকে। পরিমিত ঘুম না হলে দেহের সব কার্যকারিতা বিঘ্নিত হয়। তাই সবার সুস্থতার জন্যই নিয়ম মেনে ঘুমানো উচিত।

শিশুদের ঘুম

শিশুদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ঘুমের পরিমাণ একটু বেশি। দেখা যায় যে শিশুরা ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা ঘুমিয়ে থাকে এবং অনেক ক্ষেত্রে শিশুরা দিনের বেলা ঘুমায়, রাতে জেগে থাকে। যেহেতু নবজাতকের মস্তিষ্ক অপরিপক্ব, খুব সামান্যতেই সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং সে ঘুমিয়ে পড়ে, সুস্থ নবজাতকও প্রায় সারা দিনই ঘুমাতে পারে, দিন-রাত মিলিয়ে প্রায় ১৮ থেতে ২২ ঘণ্টা ঘুমালেও তা অস্বাভাবিক নয়। যে কয় ঘণ্টা সজাগ থাকে, তা শুধু দুধ খাওয়ার জন্য। দুধ খাওয়া শিশুর জন্য একটা পরিশ্রমের কাজ, তাই দুধ খেতে খেতেই ক্লান্ত হয়ে শিশু ঘুমিয়ে পড়ে এবং ক্ষুধা পেলে আবার কাঁদতে থাকে। কোনো কোনো নবজাতক আরো কম সময় ঘুমায়, তাতে তাদের কোনো অসুবিধা হয় না।

 কিশোর-কিশোরীদের ঘুম

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমের পরিমাণ কমতে থাকে। কিশোর-কিশোরীদের ঘুমের পরিমাণ পূর্ণবয়স্ক মানুষের মতোই হওয়া উচিত। তাদের সঠিক মানসিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় ঘুম অবশ্যই হওয়া উচিত। কিন্তু এই বয়সে কিশোর-কিশোরীরা কিছুটা কম ঘুমায়। বিভিন্ন গবেষণায় এটা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। কম ঘুমের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার। যেমন—ল্যাপটপ, মোবাইল, টেলিভিশন—এগুলোর মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার। অনেক সময় কিশোর-কিশোরীদের শারীরিক পবিবর্তনও তাদের দুশ্চিন্তার কারণ হয় এবং সে কারণে তারা কম ঘুমায়। কিন্তু এই কম ঘুম তাদের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির কারণ হতে পারে। বিশেষ করে শিক্ষাবিষয়ক কর্মকাণ্ডে তারা পিছিয়ে পড়ে।

বয়স্কদের ঘুম

পূর্ণবয়স্কদের ঘুম হওয়া উচিত ছয় থেকে আট ঘণ্টার মধ্যে। এটাই স্বাস্থ্যসম্মত। আবার বেশি বয়সীদের ক্ষেত্রে আপনাতেই ঘুমের পরিমাণ কমে যায়। দেখা যায়, পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষের দৈনিক গড় ঘুম পাঁচ-ছয় ঘণ্টার বেশি হয় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বেশি বয়সী মানুষের কম ঘুমের বড় কারণ অসুখবিসুখ। যেমন—ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, মূত্রতন্ত্রের অসুখ, অ্যাজমা,  শ্বাসকষ্ট, বাত ইত্যাদি। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, কর্মহীন সময় কাটানোর কারণে মানসিক অশান্তিতে ভুগেও কিছু বয়স্ক মানুষ ঘুমাতে পারেন না। কিছু মানুষের ঘুম কম হয় মৃত্যুচিন্তার কারণেও।

গর্ভবতীর ঘুম

সুস্থ সন্তান জন্মদান ও নিজের সুস্থতার জন্য গর্ভকালীন যথাযথ ঘুম খুব প্রয়োজন। এ সময় রাতে কমপক্ষে ছয়-সাত ঘণ্টা ঘুমানো উচিত। এ ছাড়া দুপুরের খাবারের পর আধা ঘণ্টার মতো ঘুম জরুরি। এ ছাড়া যথাযথ বিশ্রামও তাঁকে নিতে হবে।

ঘুমের ভালো সময়

রাতের ঘুম সবচেয়ে ভালো। রাতের বেলা একটি নির্দিষ্ট সময়ে যেমন—রাত ১১টার মধ্যে ঘুমাবে এবং সকাল ৬টা বা ৭টার মধ্যে ঘুম থেকে উঠে যাবে এবং এই সময়ের যেন তারতম্য না হয়।



কখন ঘুমালে ক্ষতি

রাত জেগে দিনে ঘুমালে তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কারণ রাতের ঘুমের সঙ্গে দেহের বৃদ্ধি, কোষের বিপাকীয় প্রক্রিয়া, মস্তিষ্কের কোষের স্মৃতি ও কার্যকারিতা নির্ভর করে। রাতে ঘুম যথেষ্ট পরিমাণে না হলে এগুলো ব্যাহত হয়।

সুস্থতার জন্য চাই ভালো ঘুম

কিন্তু চাইলেই তো ঘুম আসবে না। ঘুমের জন্য কিছু পরিবেশ তৈরি করা জরুরি। নিচের বিষয়গুলো মনে রাখুন। ভালো ঘুমের জন্য বিশেষজ্ঞরা এই পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

♦          ঘুমাতে যাওয়ার আগে হালকা গরম পানি দিয়ে গোসল করতে পারেন।

♦          উত্তেজক পানীয়, চা-কফি বা অ্যালকোহল ঘুমাতে যাওয়ার আগে পান করবেন না।

♦          ঘরের তাপমাত্রা খুব কম বা বেশি হওয়া চলবে না।

♦          দুপুরের খাবারের পর যাঁদের ঘুমের অভ্যাস আছে, তাঁদের সেই ঘুম যেন ২০ মিনিটের বেশি না হয়।

♦          প্রতিরাতে একই সময়ে ঘুমাতে যান এবং একই সময়ে ঘুম থেকে উঠুন। শিডিউল এলোমেলো করলে      ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবেই।

♦          ঘুমের ঘরে টিভি বা ভিডিও গেমস ইত্যাদি রাখবেন না। বিছানায় শুয়ে শুয়ে টিভি বা মোবাইল ফোন চালাবেন না।

♦          ঘুমাতে যাওয়ার অন্তত এক ঘণ্টা আগে টিভি বন্ধ করে দিন।

♦          শিশুদের ছোটবেলা থেকেই আলাদা বিছানায় রাখার অভ্যাস করুন।

♦          ঘরে উজ্জ্বল আলো ব্যবহার করবেন না। যদি ব্যবহার করতেই হয়, তবে ঘুমাতে যাওয়ার অন্তত এক ঘণ্টা আগে সেটির পরিবর্তে অল্প আলোর বাতি জ্বেলে দিন।

♦          ঘুমাতে যাওয়ার আগে উত্তেজক আলোচনা না করা ভালো।

♦          সন্ধ্যার পর চা-কফি পান না করা।

♦          প্রতিদিন ব্যায়াম করুন। তবে ঠিক ঘুমাতে যাওয়ার আগে দৈহিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম না করা উচিত।

♦          রাতে ফাস্ট ফুড বা জাংক ফুড খাবেন না। ভারী খাবারও রাতে খাওয়া উচিত নয়। যতটা সম্ভব আগেভাগে রাতের খাবার খান এবং তা যেন পরিমাণে বেশি না হয়।

♦          মোবাইল বা অন্যান্য ইলেকট্রনিকসের এলইডি লাইট ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। ঘুমাতে যাওয়ার পর এগুলোর সংস্পর্শে না যাওয়া উচিত।

♦          ভালো ঘুমাতে সাহায্য করে এমন কয়েকটি খাবার হলো—ডার্ক চকোলেট, বাদাম, কলা, মধু, দুধ ইত্যাদি।

♦          বিছানায় যাওয়ার ঠিক আগে বেশি করে পানি পান করবেন না। এতে মধ্যরাতে প্রস্রাবের বেগ পেয়ে ঘুম ভাঙবে। ঘুম আসতে দেরি হবে।

♦          সকালের নাশতা বাদ দেবেন না। নাশতা না খেলে সারা দিনই শরীর অবসন্ন থাকে। তাই রাতে আর ভালো করে ঘুম আসে না।

♦          চেষ্টা করবেন ঘুমের ওষুধের ওপর নির্ভরশীল না হতে। একবার ওষুধের ওপর নির্ভরশীল হলে সহজে স্বাস্থ্যকর ঘুমের অভ্যাসে ফিরে আসা যায় না।

♦          রাতের ঘুম রাতেই ঘুমাতে হবে। কেউ যদি মনে করে, ২৪ ঘণ্টায় সাত-আট ঘণ্টা ঘুম দরকার—সেটা দিনে ঘুমিয়ে নিলেই চলবে। তা আসলে ঠিক নয়। এতে অনিদ্রারোগ হবেই। কারণ ঘুমের জন্য যে রাসায়নিক মস্তিষ্কে নিঃসৃত হয়, সেই মেলানিন সূর্যের আলোয় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।

পরামর্শ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেসপিটেরি মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ও স্লিপ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোশাররফ হোসেন, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০, গ্রন্থনা : সীমা আক্তার
http://www.kalerkantho.com/print-edition/doctor-acen/2016/12/24/444395

No comments:

Post a Comment