ঢেঁকি কুলা থেকে কুঁড়েঘর। কড়কড়ে তাঁতের শাড়ি আর ফুলের গয়না। বিয়ের আগের দিন বর-কনের গায়েহলুদ আয়োজনের সবটাই দেশি। যেন ষোলো আনা বাঙালি হয়ে ওঠার চেষ্টা। আজকাল বিয়ে
বাড়িতে তাই মূল আকর্ষণ গায়েহলুদের আয়োজন। বর আর কনে—কার বাড়িতে কতটা অভিনব দেশীয় সাজসজ্জা হলো, তা নিয়ে চলতে থাকে গপ্পো। অনেকটা ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’ প্রতিযোগিতার মতো।
গায়ে হলুদের মঞ্চ
বাজেট যেমন আয়োজন তেমন। এ তো জানা কথাই। তবে সেখানে নতুন নতুন চিন্তাভাবনা যোগ করে আনা হচ্ছে নতুনত্ব। সৃজনশীলতায় আয়োজন হয়ে ওঠে বর্ণিল উৎসবমুখর। বিয়ে বাড়ির সাজসজ্জা নিয়ে কাজ করে ওয়াইফা ওয়েডিং অ্যান্ড ইভেন্টস। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান সাইফুর রহমান বলেন, ‘গ্রাহকের সঙ্গে যখন কথা বলি সবারই চাওয়া থাকে হলুদের মঞ্চটা যেন নাটকীয় হয়। অনেক সময় তাঁরা যা চাচ্ছেন সেটার কোনো ছবি তুলে বা এঁকে দেন আমাদের। কেউ আবার গল্পের মতো করে বুঝিয়ে দেন। তবে সবটাই হওয়া চাই দেশি। গ্রাহকের ইচ্ছেমতো আমরাও খড়ের গাদা, কুঁড়েঘর, ফুলের বাগান, বটগাছের নিচে মঞ্চ করে দিই।’

এসব কারণেই আজকাল ইট-কাঠের শহরেও দেখা যায় গ্রামের আবহ। অনেকেই রিকশা পেইন্ট করে মঞ্চ বানায়। মঞ্চের ওপরেই হয়তো কনের বসার জন্য রাখা হলো রিকশা কিংবা হুডসহ রিকশার সিটটা। আর পটভূমিতে রিকশাচিত্র থাকলে তো কথাই নেই। শীত এলে, মানে বিয়ের মৌসুমে চারুকলার শিক্ষার্থী শিল্পীদের কাজের চাপ বেড়ে যায়। পড়াশোনার পাশাপাশি অনেকেই বিয়ের অনুষ্ঠানের কাজ করেন। বিয়ে বাড়ির সাজসজ্জায় অন্য অনেকের চেয়েই তাঁদের চাহিদা বেশি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থী সুষ্ময় ওম দে অনেক দিন ধরেই নানা ধরনের অনুষ্ঠানে কাজ করেন। গায়েহলুদ বা বিয়ে বাড়ির মঞ্চ ছাড়াও হলুদের ডালা-কুলা, মাটির হাঁড়ি-কলসি, পটারি, সরা, আলপনা ইত্যাদির নকশা করে দেন। সুষ্ময় বললেন, ‘হলুদে সবাই নতুন কিছু না কিছু করতে চান। আমরাও সেই চেষ্টা করি। ছাদে বা কমিউনিটি সেন্টারে অনেকে তাজা কলাগাছ বসিয়ে গ্রামীণ বিয়ে বাড়ির আবহ আনতে সেখানে রঙিন কাগজ ব্যবহার করেন। মঞ্চের আদল ধরেই অনেকে কনের বসার জন্য ঢেঁকি তুলে আনেন মঞ্চে। ছোট গরুর গাড়ি, কাঠের চৌকি, বেতের মোড়া, পুকুর ঘাটের আদল ইত্যাদিও দেখা যায় হলুদে।’
শাড়িবিয়েরদিনের জন্য বেনারসি ঠিক করে রাখলেও হলুদের শাড়িটা কম গুরুত্বপূর্ণ না। সেখানে ঘুরেফিরে জামদানি, কোটা তাঁতের শাড়ি বা সিল্কেই ভরসা রাখতে পারেন। টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরের স্বত্বাধিকারী মুনিরা এমদাদ বলেন, ‘একটা টাটকা তাঁতের শাড়ি আর ফুলের গয়না পরে কনে হলুদের মঞ্চে বসে আছেন, এই দৃশ্য একবার ভাবুন। আহা! প্রাণটা ভরে উঠবে। হলুদের জন্য কেনা একটা বিশেষ জামদানি বা সিল্ক শাড়ি কিন্তু একদিনই না, পরেও পরতে পারবেন। এসব শাড়ি আপনার সংগ্রহে থাকা মানে নিজের ওয়্যারড্রোবও কিন্তু সমৃদ্ধ হওয়া। ঠিকভাবে যত্নে রাখলে সেটা পরের কয়েক প্রজন্ম পরতে পারবে।’ বলছিলেন মুনিরা এমদাদ।
সাজও গয়না‘হলুদ বাটো মেন্দি বাটো...’ ব্যাপারগুলো আজকাল সহজ করে দিয়েছে নাগরিক জীবন। টিউবের মধ্যে তৈরি মেহেদি বা বাটা হলুদ পাওয়া যায়। তবে হলুদটা অনেকেই এখনো বেটে নেন। কাঁচা হলুদ কিনতেও পাওয়া যায়। আর হলুদের কনের সাজে কাঁচা ফুলের গয়নার সঙ্গে অন্যকিছুর তুলনা চলে না। সেটা মনে করিয়ে দিয়ে হেয়ারোবিক্স ব্রাইডালের রূপবিশেষজ্ঞ তানজিমা শারমীন বলেন, ‘শীতের সময় নানা ধরনের ফুল পাওয়া যায় বাজারে। এসব ফুল দিয়ে কনের হলুদের গয়না করা যায়। সঙ্গে নানা ধরনের পুঁতি ব্যবহার করা হচ্ছে এখন। চুলের সাজে বেণি বা খোঁপায় ফুল ব্যবহার হচ্ছে।’ তানজিমা শারমীন বলেন, ‘হলুদের কনের লুকটা সব সময় ন্যাচারাল থাকলেই ভালো দেখাবে। চোখ বা ঠোঁট সাজাতে পারেন কিছুটা জমকালো করে।’

চুলে ও গয়নায় ফুলের ব্যবহারই এই সময়ের কনের জন্য উপযুক্ত সাজ। সাইড সিঁথিতে বেণি করে ঝাপটা পরলে ভালো দেখাবে। চুলের বেণিতে হলুদ ফিতা ও টকটকে লাল গোলাপের ব্যান্ড দেখাবে অভিনব।
ঐতিহ্যবাহী সাজশুধু যেগ্রামীণ আবহ এনে সেটা তৈরি করা হয়, সেটা না। অনেকেই দেশের ঐতিহাসিক স্থাপনার আদলে সেট তৈরি করে সেখানে বিয়ে বা হলুদের আয়োজন সম্পন্ন করেন। ২০১৪ সালে মেয়ের বিয়ের জন্য মাত্রার পরিচালক সানাউল আরেফিন নিজেদের গ্রামের বাড়ির আদলে সেট বানিয়েছিলেন রাজধানীর সামরিক জাদুঘর মাঠে। ১০০ বছরের পুরোনো দাদার হাতে তৈরি বাড়িতে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার শখ থেকেই তিনি এমনটি করেছিলেন বলে জানান। অনেকে আবার জমিদার বাড়ি বা মন্দিরের আদলে তৈরি করেন হলুদের মঞ্চ। ককশিট বা বোর্ড দিয়ে এসব সেট বানানো হয়।
বর-কনেরভাইবোনেরাহলুদের আয়োজনে বর হোন আর কনে, তাঁদের সাজসজ্জা তো আছেই, বাড়ির অন্যদের সাজও এখন চোখে পড়ে মোটাদাগে। কারণ, ভাইবোনেরা একই ধরনের পোশাক বেছে নেন। আজিজ সুপার মার্কেটের অতঃপর দোকানের স্বত্বাধিকারী রানা আহমেদ বললেন, ‘হলুদের আয়োজনের জন্য অনেকেই রং বেছে নিয়ে পাঞ্জাবি তৈরি করে নিতে আসেন। একই ধরনের শাড়িও বানিয়ে নেন অনেকে।’
শুধু কি পোশাক! ভাইবোনেরা মিলে আয়োজন করেন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বিশেষ করে নাচ। জনপ্রিয় কিছু গান বেছে নিয়ে গোপনে নাচের মহড়া করে মঞ্চে ওঠেন অনেকে। এ ছাড়া হলুদের মঞ্চের পাশে জারিগান, বাউল গান বা আঞ্চলিক গানের আসর বসাতেও দেখা যায়।
আলপনাসুষ্ময় ওম দে বলেন, ‘আলপনা সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে বিয়ে বাড়িতে। অনেকেই শুধু হলুদের জন্য বিশেষ আলপনা করে নেওয়ার জন্য আসেন।’
হলুদের মঞ্চের আশপাশে, বাসার সিঁড়িতে, ছাদে অনুষ্ঠানস্থলের পুরো জায়গায়, বারান্দায় ঘরের মেঝেতে আলপনা আঁকার চল বেড়েছে।
ডালা-কুলাহলুদের নানা ধরনের তত্ত্ব সাজিয়ে আনা হয় ডালা ও কুলায় করে। ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডের হলুদের সরঞ্জাম বিক্রেতা আইনুল হক বলেন, ‘নানা আকারের ডালা ও কুলা কিনতে পাওয়া যায়। লোকজন রেডিমেড (তৈরি) ডালাকুলা ছাড়াও আলাদা করে উপকরণ কিনে নিজেরা বানিয়ে নেন। সাজানোর সব ধরনের ফুল, ফিতা, কাগজ, পলি, লতাপাতা ইত্যাদি কিনতে পাওয়া যায়। নিজেরা তৈরি করে নিলে সেটা সাধারণত আলাদা হয়।’
গায়েহলুদের আরও একটি বিষয়ে বিশেষ জোর থাকে, সেটা হচ্ছে অতিথিদের উপহার দিয়ে বরণ করে নেওয়া। একপক্ষ যখন অন্যপক্ষের বাড়িতে হলুদের তত্ত্ব নিয়ে আসে, তখন তাদের ফুল ছিটিয়ে আর উপহার দিয়ে বরণ করতে দেখা যায়। হলুদের উপহার হিসেবে চাবির রিং, ক্লিপ, হেয়ার ব্যান্ড, ছোট পার্স, চকলেটের ডালা, খেলনা, মাটির শো-পিস, পুতুল, রাখি, হাতঘড়ি, উত্তরীয় নানা কিছু দেওয়ার চল আছে। অনেকে চাবির রিং বা সিরামিকের মগে বর কনের ছবি প্রিন্ট করে সেটা উপহার হিসেবে সবাইকে দিয়ে থাকে। আয়োজন যা-ই হোক, সেখানে একটা অলিখিত প্রতিযোগিতা থাকেই এই সময়ের হলুদে। এই প্রতিযোগিতা বেশি বেশি দেশি জিনিস ব্যবহারের। এই প্রতিযোগিতা দেশের সাংস্কৃতিকে নতুনভাবে উপস্থাপনের।
No comments:
Post a Comment